কবর খনন ও লাশ রাখার সুন্নাত (পদ্ধতি) তরিকা!

মুফতি হারুনুর রশীদ ।।

কোন মুসলমান মারা গেলে তার জানাযার নামাজ পড়া ও দাফন করা ফরযে কেফায়া। (ফাতওয়ায়ে আলমগিরীঃ ১/১৬২, ফাতওয়ায়ে শামীঃ ৩/১০২) তথা এই ফরয হুকুম যদি মুসলমানদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোক আদায় করে তাহলে সকলেই দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যাবে। আর যদি কেউই আদায় না করে তাহলে সকলেই গুনাহগার হবে।তাই এই গুরুত্বপূর্ণ হুকুম সঠিকভাবে জানার জন্য কবর খননের পদ্ধতি ও লাশ রাখার নিয়ম বিস্তারিত আলোচনা নিচে উল্লেখ করা হলো।

শরিয়ত সম্মত কবর দুই প্রকার: ১. লাহদ বা বগলী ২.শাক্ক বা সিন্দুকী।

লাহদ বা বগলী কবরের বিবরণঃ লাশ যতটুকু লম্বা হয় কমপক্ষে তার অর্ধেক বা আরো বেশি খনন করার পর পশ্চিম দিকে একটি বাক্সের মত গর্ত খনন করবে, যাতে করে তাতে লাশ রাখা যায়। সেখানে লাশটা রাখার পর পশ্চিম দেকের গর্তটা কোনকিছু দিয়ে বন্ধ করে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিবে।

শাক্ক বা সিন্দুক কবরের বিবরণঃ প্রথমে মৃতব্যক্তির সিনা বা কাঁধ বরাবর বা আরো বেশি খনন করার পর খালের ন্যায় ছোট একটি গর্ত খনন করবে এবং তাতে মৃত ব্যাক্তিকে রাখবে এবং ঐ ছোট গর্তের উপরে বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে মাটি দিবে। (ফাতওয়ায়ে শামিঃ ৩/১৩৯, বাহরুর রায়েকঃ ২/২০৮, বাদাইয়ুস সানায়েঃ ২/৩৫৮, আহসানুল ফাতওয়াঃ ৪/২২৪ )।

উপরোউল্লেখিত দুই প্রকার কবরের মধ্যে লাহদ কবর বানানো উত্তম। আর যদি মাটি নরম হওয়ার কারণে লাহদ কবর বানানো সম্ভব না হয় বা বানানোর সাথে সাথে ভেঙ্গে পড়ার আশংকা থাকে তাহলে শাক কবর বানানোও জায়েজ আছে। কারণ রাসুল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ- اللحد لنا আমাদের মুসলিম উম্মার জন্য লাহদ কবর।(তিরমিজি শরীফঃ ১/২০২)।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, আমাদের এলাকায় যে পদ্ধতিতে কবর খনন করা হয়, অর্থাৎ প্রথমে অর্ধহাত বা তার থেকে কিছু বেশি খনন করার পর হালকা একটু ছোট করে তিন হাত বা সমপরিমান আরো খনন করে তাতে মৃত ব্যাক্তিকে রাখা হয়৷ আর ঐ অর্ধহাত পরিমান খনন করার পর হালকা ছোট করা হয়েছিল, তাতে বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে মাটি দেয়া হয়। এমতাবস্থায় মৃত ব্যাক্তি এবং বাশের ছাদের মধ্যখানে প্রায় তিন হাত ফাকা থাকে। এই পদ্ধতি শরিয়ত সমর্থিত নয়। তাই এই পদ্ধতি ছেড়ে, শরিয়ত সম্মত দুই পদ্ধতি থেকে যেকোনো এক পদ্ধতি অনুযায়ী কবর খনন করতে হবে। যাতে করে সুন্নাত মোতাবেক মৃত ব্যক্তির সম্পূর্ণ শরীর ডান কাতে রাখা যায়।

কবরে নামানোর নিয়মঃ জানাজার নামাজের পর মৃত ব্যক্তিকে পশ্চিম দিক থেকে কবরে নামাবে। যাতে করে কবর থেকে যারা লাশটা ধরবে তারা কিবলামুখী হয়। ( ফাতওয়ায়ে শামীঃ ৩/১৪০, আল বাহরুর রায়েকঃ ২/৩৩৯)।

কবরে লাশ রাখার সময় ‘বিসমিল্লাহি ওয়া বিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ।’ অর্থ : আল্লাহর নামে, আল্লাহর হুকুমে এবং আল্লাহর রাসুলের ধর্মের (মতাদর্শের) উপর।’

এ দোয়া পাঠ করে মুর্দাকে সম্পূর্ণ ডান কাঁতে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে৷ এটাই সুন্নাত তরীকা। কারণ উমাইর ইবনে কাতাদাহ রাঃ থেকে বর্নিত আছে যে, عمير بن قتادة أن النبي صلى الله عليه وسلم قال في البيت الحرام : (قِبْلَتِكُمْ أَحْيَاءً وَأَمْوَاتًا) আবু দাউদ শরীফ- হাঃ নাঃ ২৮৭৪।(আদ দুররুল মুখতার, ২/২৩৬, ফাতওয়ায়ে আলমগীরীঃ ১/১৬৬, আহকামে মায়্যিত- ২৩৬)।

উল্লেখিত আলোচনার মাধ্যমে জানা যায় যে, মৃত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ ডান কাতে শোয়ানোর সুন্নাত। কিন্তু কোন কোন এলাকায় মৃত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ ডান কাতে না শোওয়ায়ে, চিৎ করে শোওয়ায়ে শুধুমাত্র চেহারাকে কিবলামুখী করা হয়। এই পদ্ধতি সুন্নাত সম্মত নয়। আফসোসের কথা হচ্ছে, মুখে রাসুল সাঃ এর তরীকায় শোয়ানোর কথা স্বীকার করা হয়, অথচ কাজ করা হয় তার ঠিক উল্টো।

অর্থাৎ মৃতব্যক্তিকে কবরে চিৎ করে শোয়ায়ে শুধুমাত্র চেহারা কেবলামুখী করা হয়, যা রাসুল সাঃ তার উম্মতকে শিক্ষা দেননি। এ ব্যাপারে শরীআতের মাসআলা হল, জীবিত মানুষ যেভাবে সুন্নাত তরীকায় ডান কাতে শয়ন করে, মুর্দাকে সেভাবে কবরে ডান কাঁতে শোয়ানো সুন্নাত। চিৎ করে শোওয়ায়ে ঘাড় মুচড়িয়ে শুধুমাত্র চেহারাটাকে কোন রকমে কিবলামুখী করা শরীয়াত সম্মত নয় বরং সম্পূর্ন ডান কাঁতে শোয়াবে, যাতে স্বাভাবিক ভাবে চেহারা কিবলামুখী হয়ে যায়। কারণ শরীআতে সীনা গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন, নামাযে মুখ ঘুরে গেলে নামায মাকরূহ হয়, কিন্তু নামাজ ভঙ্গ হয় না, অথচ সীনা ঘুরে গেলে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যায়৷

সুতরাং ভারতবর্ষে সীনা আসমানে দিকে রেখে চিৎ করে শুইয়ে দাফন করার যে গলদ তরীকা চালু হয়ে গেছে তার আশু অবসান হওয়া জরুরী।

আমাদের বর্তমান সমাজে এমন অসংখ্য ভুল প্রচলন রয়েছে, যেগুলোর ভিত্তি কোরআন বা হাদিসে নেই। কিন্ত আফসোসের কথা হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই প্রচলনকেই কোরআন ও হাদিসের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। বলা হয়- আমাদের বাপ-দাদারা এরকম করে আসছে।

যেমন শবে বরাতে মিষ্টি, হালুয়া, রুটি বিতরণ, আতশবাজি ফোটানো ইত্যাদি। এরকম আরো একটি ভুল প্রচলন হলো, লাশকে কবরে রাখার পর শুধুমাত্র চেহারাকে কেবলামুখী করে দেয়া। অথচ সুন্নত পদ্ধতি হলো, মাইয়্যেতকে কবিরে এমন ভাবে শোওয়ানো যাতে সিনা ও চেহারা অর্থাৎ সম্পূর্ণ শরীর কেবলার দিকে হিয়ে যায়। প্রয়োজনে মাইয়্যেতকে পূর্বের দেয়ালের সঙ্গে ঠেক লাগিয়ে রাখবে। যেন মাইয়্যেতকে সহজে ডান কাত করে রাখা যায়।

যারা দাফনে অংশগ্রহণ করবে যদি সম্ভব হয় তাহলে মাথার দিক থেকে ডান হাতে তিন মুঠ মাটি দিবে। প্রথম মুঠ মাটি দেয়ার সময় বলবে منها خلقناكم অর্থ ( আল্লাহ তায়া’লা বলেছেন) এ মাটি দ্বারাই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি। দ্বিতীয় মুঠ মাটি দেয়ার সময় বলবে وفيها نعيدكم অর্থ এ মাটির ভিতরেই তোমাদেরকে পুনরায় আনব। তৃতীয় মুঠ মাটি দেয়ার সময় বলবে ومنها نخرجكم تارة أخرى অর্থ এ মাটির ভিতর থেকে আমি তোমাদেরকে পুনরায় বের করব। (ফাতওয়ায়ে শামীঃ ৩/১৪৩)।

দাফন শেষে মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ মাগফিরাত করা অথবা মৃত ব্যক্তির মাথার দিকে দাঁড়িয়ে সুরা বাকারার শুরু থেকে مفلحون পর্যন্ত, এবং পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া মুস্তাহাব। তবে আবশ্যকীয় মনে করা ঠিক নয়। (ফাতওয়াওয়ে শামীঃ ৩/১৪৩, ফাতওয়ায়ে দারুল উলুমঃ ৫/৩৯০)।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত আছে যে, (দাফনের পর) মাথার পাশে দাঁড়িয়ে সুরা বাকারার প্রথম আয়াত গুলো ( শুরু থেকে مفلحون পর্যন্ত) এবং শেষ আয়াত গুলো ( امن الرسول থেকে শেষ পর্যন্ত) পড়বে। (বাইহাকি শরীফ হাদিস নং – ৭০৬৮) মিশকাত শরীফ পৃষ্ঠা – ১৪৯)।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মৃত ব্যক্তির দাফন সুন্নাত অনুযায়ী সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক গুলের হাওর মুয়াজ ইবলে জাবাল মাদরাসা।

আরও খবর